প্রাণের শহর কলকাতা আর সেই শহরেরই স্পন্দন হাওড়া ব্রিজ। কলকাতা ও হাওড়া দুই যমজ শহর আর তাদের মধ্যেই সংযোগ রক্ষা করে এই হাওড়া ব্রিজ। পরবর্তীকালে এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে শ্রধ্যার্ঘ জানিয়ে যার নাম রাখা হয় রবীন্দ্র সেতু। কলকাতা এবং হাওড়া এই দুটি শহরই বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং সেই ইতিহাসেরই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় জড়িয়ে রয়েছে এই হাওড়া ব্রিজের সাথে। ব্রিটিশ যুগে বাংলার বুকে নির্মিত এই সেতুটি দেশ-বিদেশে আজও সমানভাবে বিখ্যাত। তবে, প্রতিদিন প্রায় ৩ লাখ যানবাহন এবং সাড়ে চার লক্ষ পথচারীর ভারবহনকারী এই ঝুলন্ত সেতুর ইতিহাস হয়ত আপনাদের অনেকেরই অজানা।
• হাওড়া ব্রিজের ইতিহাসঃ
ভারতের ঐতিহ্য এবং সম্পদ দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে বহু বিদেশী শক্তি বারবার এই দেশ আক্রমণ করেছে তার মধ্যে বাণিজ্যের হাত ধরে ভারতে প্রবেশ করা ব্রিটিশ শক্তি আমাদের মাতৃভূমিতে এক অন্ধকার অধ্যায়ের সূচনা করে। প্রায় বছর ধরে আমাদের দেশ শাসন করার দৌলতে এই দেশের বুকে এখনও রয়ে গেছে ব্রিটিশ শক্তির নির্মিত বিভিন্ন স্থাপত্য। তারই মধ্যে অন্যতম হল হাওড়া ব্রিজ।
সালটি ১৮৫৭, সিপাহী বিদ্রোহ দমন করে ব্রিটিশরা জাঁকিয়ে বসল ভারতের মাটিতে। ব্রিটিশ শাসনের রাজধানী ছিল কলকাতা। এই দেশের নানান সম্পদ বিদেশে রপ্তানি হতে শুরু করে। ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ল এবং পণ্য সামগ্রীর বিনিময়কে সহজ করার জন্য ১৮৬০ সালে তৈরি হল হাওড়া স্টেশন। কিন্তু রাজধানীর সাথে কীভাবে যোগাযোগ হবে? বাণিজ্য বাড়ার সাথে সাথে শুধুমাত্র জলপথে কেবল জিনিসপত্র ও যাত্রীর আনাগোনা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই হাওড়া ও কলকাতাকে সংযোগকারী একটি সেতু নির্মাণের চিন্তাভাবনা করা হল। ১৮৭১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক পাস হল “The Howrah bridge Act” এবং কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টকে এই সেতুটি নির্মাণের তদারকি করার দায়িত্ব দেওয়া হল।
এরপর বিখ্যাত সিভিল ইঞ্জিনিয়ার স্যার ব্র্যাড ফোর্ড লেসলির সাথে হুগলী বক্ষে একটি ভাসমান ব্রিজ তৈরি করার চুক্তি হল। তবে সেতুটি নির্মাণকালে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হলেও ১৮৭৪ সালে ব্রিজটির পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়। এই ব্রিজটি তৈরি করতে খরচ হয়েছিল প্রায় ২২ লক্ষ টাকা। ব্রিজটির বিভিন্ন অংশ ইংল্যান্ড থেকে আমদানি করে এখানে সংযোগ করা হয়। ব্রিজটি ছিল ১৫২৮ ফুট লম্বা, ৬২ ফুট চওড়া। নদীর জলতল থেকে ব্রিজটির উচ্চতা খুব বেশি না হওয়ায় জাহাজ বা স্টিমার যাতায়াত করলে ব্রিজটি মাঝখান থেকে খুলে দেওয়া হত। তার জন্য বেশ কিছুক্ষণ ব্রিজের ট্র্যাফিক বন্ধ থাকত। এছাড়াও ব্রিজটির বহন ক্ষমতা খুব সীমিত ছিল এবং এটি বানানো হয়েছিল স্বল্পমেয়াদী চিন্তাভাবনা করে।
পরিকল্পনার পর্যায় থেকেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সহ অন্যান্য নানান বাধা পার করে অবশেষে ১৯৩৭ সালে রেন্ডল পামার অ্যান্ড ট্রেটন কোম্পানির চিফ ড্রাফটসম্যান মি: ওয়ালটন-এর ডিজাইন অনুযায়ী শুরু হয় হাওড়া ব্রিজ নির্মাণের কাজ। ব্রিজ নির্মাণের তত্ত্বাবধানে ছিল ক্লিভল্যান্ড ব্রিজ অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। সহযোগী ছিল ব্রেথওয়েট বার্ন অ্যান্ড জেসপ কনস্ট্রাকশন কোম্পানি।
কিন্তু আবারও বাধা। ১৯৩৯ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ফলে যে ব্রিজটি তৈরীর জন্য প্রয়োজন ছিল ২৬০০০ টন স্টিল, তার মাত্র ৩০০০ টন স্টিল দেওয়ার পরেই ইংল্যান্ড থেকে বন্ধ হয়ে যায় স্টিলের supply। কিন্তু ব্রিজটি তো অত্যন্ত জরুরি। তাই তখন ভারতের টাটা স্টিল কোম্পানি প্রস্তুত করে বাকি ২৩ হাজার টন হাইটেনশন স্টিল এবং প্রায় ২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা খরচ করে তৈরি হয় ২৩১৩ ফুট দৈর্ঘ্য, ৭১ ফুট প্রস্থ ও ২৬৯ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন হাওড়া ব্রিজ। এই ব্রিজের আরো একটি আশ্চর্যজনক বিষয় এই বৃহৎ ব্রিজটি তৈরি করতে কোন নাট বল্টু ব্যবহৃত হয়নি। অবশেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাপানিজদের সম্ভাব্য আক্রমণের ভয়ে অনাড়ম্বরভাবেই শুধুমাত্র একটি ট্রাম চালিয়ে উদ্বোধন করা হয় এই বিখ্যাত হাওড়া ব্রিজের।
• হাওড়া ব্রিজের বর্তমান অবস্থাঃ
সেদিন থেকেই সমস্ত প্রাকৃতিক অপ্রাকৃতিক ঝড়ঝাপটা সামলে অবিরাম কাজ করে চলেছে হাওড়া ব্রিজ। ৬০ হাজার টন ওজন নেওয়া ক্ষমতাধারী এই ব্রীজ প্রায় এক লক্ষ টন ভার বহন করছে। কিন্তু মানুষের কিছু ক্রিয়া-কলাপ আজ এই অবিশ্বাস্য স্থাপত্যকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যাচ্ছে। পশুপাখির বর্জ্য ছাড়াও, পচা ফুল-ফল-সবজি সর্বোপরি পানের পিক সমূহভাবে ক্ষতি করে চলেছে এই ব্রিজের ইস্পাতের। এই ব্রিজের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে রয়েছে কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট, যারা ইস্পাতের পিলারগুলিকে fibred glass দিয়ে ঢেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রেখে ক্রমশ ৭৬ বছরের পুরনো এই ঐতিহাসিক স্থাপত্যকে রক্ষা করার চেষ্টা করে চলেছে। কিন্তু বাংলার গর্ব বা গেটওয়ে অফ কলকাতাকে রক্ষা করার দায়িত্ব সমস্ত মানুষের। সচেতন হন, অন্যকে সচেতন করুন, এগিয়ে আসুন।
0 মন্তব্যসমূহ